gramerkagoj
শনিবার ● ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
gramerkagoj
নারীযোদ্ধা আম্বিয়া শফির অবদান ভোলার নয়
প্রকাশ : বুধবার, ১ মার্চ , ২০২৩, ১২:৩৪:০০ এ এম , আপডেট : বুধবার, ২৪ এপ্রিল , ২০২৪, ০৩:০১:২৯ পিএম
পারভীনা খাতুন ::
GK_2023-10-02_651acb08506b6.jpg

‘যুদ্ধের ময়দানে এক হাতে অস্ত্র তাঁর অন্য হাতে ক্যামেরা’- যশোরের প্রখ্যাত আলোকচিত্রী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ শফির সহধর্মিণী আম্বিয়া শফি। আম্বিয়া নিজেকে অত্যন্ত সৌভাগ্যবান মনে করেন। কারণ তাঁর স্বামী যশোরের গৌরব। তিনি একদিকে যুদ্ধ করেছেন অন্যদিকে পাকিস্তান বাহিনীর নির্মম-নিষ্ঠুরতা ও তান্ডবলীলার ছবি তুলে ইতিহাসে স্বাক্ষীকরে রেখেছেন।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাদের শেলের আঘাতে আম্বিয়াদের গ্রাম লন্ডভন্ড হয়ে যায়। তখন আম্বিয়া বাড়ি ফেলে পরিবারসহ শরণার্থীদের সাথে ভারতে চলে যান। প্রথম গিয়ে ওঠেন বেনাপোলের ওপারে ভারতের জয়ন্তীপুরে। তারপর তাদের আশ্রয় হয় বনগাঁ ক্যাম্পে। বাবা-মা, দাদির নিষেধ উপেক্ষা করে আম্বিয়া মুক্তিযুদ্ধের লিয়াজোঁ অফিসে যান যুদ্ধে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে। এই সময় তিনি বনগাঁয় মুক্তিযুদ্ধের লিয়াজোঁ অফিসের অফিস সহকারী আশরাফ আলীর সহায়তায় তবিবুর রহমান এমপির কাছ থেকে একটি চিঠি নিয়ে গোবরা ক্যাম্পে যান। তাঁর সঙ্গে আরো ছিলেন নাজমা খাতুন, মাজেদা বেগম, কানিজ বেগম ও ফাতেমা বেগম। সেখানে তাঁদেরকে রাইফেল ও গ্রেনেড চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ প্রশিক্ষণ চলে টানা ২০ দিন। সফলভাবে প্রশিক্ষণ শেষ করে তিনি সেনাবাহিনীর (অব.) অফিসার নজরুল ইসলামের কাছে আরও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
আম্বিয়া শফির মেয়ে মৌসুমি ফৌজী রজনী বলেন, ‘আমার মা যখন ক্লাস নাইনে পড়ে তখনই যুদ্ধের শুরু। ১৯৫৭ সালের ৩১ শে জানুয়ারি আমার মায়ের জন্ম যশোরের শার্শা উপজেলায়। শার্শা উপজেলার সদরে আমার মায়ের বাড়ি। আমার নানার নাম ডাক্তার মাওলা বক্স বিশ্বাস। নানা আওয়ামী লীগ করতেন এবং তৎকালীন সময়ে ভারতের বনগাঁ অফিসে অফিসিয়াল কাগজ পত্র  লেখার কাজে নিযুক্ত ছিলেন। ১৯৭১ এর মার্চে তিনি ভারতে চলে যান। এরপর রাজাকাররা প্রতিনিয়ত রাতের বেলায় আমার নানা বাড়িতে গিয়ে উৎপাত করত। এ সময় আমার মা ও তার বোনেদের সম্ভ্রম রক্ষার্থে পাশের বাড়িতে ধানের ডোল মুড়ি দিয়ে লুকিয়ে থাকত। এভাবে দিনের পর দিন কাটতো। সাতদিন ধরে লুকিয়ে থাকার পর ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাদের শেলের আঘাতে আমার নানা বাড়ির গ্রাম লন্ডভন্ড হয়ে যায়। তখন নানা বাড়ির সবাই ঘড়-বাড়ি ফেলে পরিবারসহ শরণার্থীদের সাথে চলে যায় ভারতে।’
যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের আহত হওয়ার সংখ্যা এত পরিমাণে বৃদ্ধি পেত যে, রোগী সামলাতে সবাইকে হিমশিম খেতে হত। তখন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত মোতাবেক নারী যোদ্ধাদের নার্স হিসেবে আগরতলা অস্থায়ী হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এর অংশ হিসাবে আম্বিয়াসহ আরও প্রায় ১৫ জনকে আগরতলায় পাঠানো হয়। সেখানে তিনি ডা. ক্যাপ্টেন সেতারা বেগমের (বীর প্রতীক) তত্ত্বাবধানে কাজ করতেন। আগরতলা পৌঁছানোরপর আম্বিয়াদের আবার পুনরায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তবে এবার আম্বিয়া প্রশিক্ষণ নেন শুধুমাত্র নার্সিং বিষয়ে। প্রশিক্ষণ শেষ করে আহত যোদ্ধাদের সুস্থ করার জন্য কাজ শুরু করেন তিনি। মে মাসে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। এরআগে তাঁর অস্ত্র ট্রেনিং হয়েছিল গোবরা ক্যাম্পে আর নার্সিং ট্রেনিং নীলরতন হাসপাতালে।
মৌসুমি ফৌজী রজনী আরো বলেন, ‘যুদ্ধের পরপরই আমার মায়ের ও বাবার বিয়ে হয়। সৌভাগ্যক্রমে আমার বাবা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ফটো সাংবাদিক। যুদ্ধের ময়দানে আমার বাবা এক হাতে যেমন বন্দুক নিয়ে যুদ্ধ করেছেন ঠিক তেমনি অন্য হাতে ক্যামেরাও রেখেছেন। আমার বাবা মোহাম্মদ শফি একজন প্রখ্যাত আলোকচিত্রী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। বিয়ের পরে মা সংসারের পাশাপাশি সমাজসেবা মূলক কাজ শুরু করেন। ১৯৯৭ সালে আমার পিতার মৃত্যুর পর তিনি অথৈ সমুদ্রে পড়েন। কারণ আমরা তিন বোনের মধ্যে ২ জন ছোট ছিলাম। তখন মা তাঁর এক বান্ধবীর এনজিও’তে সামান্য বেতনে চাকুরী নেন। সেখানে দু’বছর চাকরি করার পর নিজেই ‘চেতনা’ নামে একটি এনজিও পরিচালনা করেন এবং সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষ ও গ্রামের দরিদ্র কৃষকদের সাথে কাজ শুরু করেন। মৃত্যুর আগ পযর্šÍ তিনি এই কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন।’
১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়ী হলেও এই বীর মুক্তিযোদ্ধা দীর্ঘ ১০ বছর কিডনি জনিত সমস্যার সাথে যুদ্ধ করে পরাজিত হন। ‘আম্বিয়া শফি’ ২০২১ সালের ১২ জুন (শনিবার) তাঁর তিন কন্যাকে রেখে ইন্তেকাল করেন।

আরও খবর

🔝